ডেস্ক রিপোর্ট ঃ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা (প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং) বাছাই ও প্যানেল তৈরির কার্যক্রমে নিজস্ব লোকবলের এখতিয়ার কমিয়ে দিচ্ছে ইসি। এ কার্যক্রমে যুক্ত করা হচ্ছে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ওসিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের।
জেলা পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে সাত/ছয় সদস্য এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও’র নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি এ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সদস্য সচিব হিসাবে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার (১৭ আগষ্ট) নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করে ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও নিয়োগ নীতিমালা’ খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের এ সংক্রান্ত কমিটি।
আগামী সোমবার অনুষ্ঠেয় নির্বাচন কমিশনের ২২তম সভায় এটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার জন্য বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছে।
সেখানে অনুমোদন পেলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এ নীতিমালা কার্যকর হলে জাতীয় সংসদের মতো একই পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনেও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ হবে।
সংশ্লিষ্ট জানা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, এর আগেও ইসির কর্মকর্তাদের এখতিয়ার কমিয়ে একাধিক নীতিমালা ও প্রজ্ঞাপন জারি করে বর্তমান কমিশন।
এই মুহূর্তে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের যে কাজ চলমান, সেই কার্যক্রমের নীতিমালাতে কয়েক দিন আগে ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসিসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হয়। খর্ব করা হয় ইসি কর্মকর্তাদের একক ক্ষমতা।
স্থানীয় প্রশাসক দিয়ে ভোটকেন্দ্রের খসড়া তৈরি করতে গিয়ে গলদগর্ম হয়েছে কমিশন।
খসড়া প্রকাশের দিনেও বিভিন্ন জেলায় মিটিংয়ের পর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত যে সংখ্যক ভোটার বেড়েছে, সেই হারে ভোটকেন্দ্র বাড়েনি, বেড়েছে ভোটকক্ষ। খসড়ায় ৫.৪৭ শতাংশ ভোটকেন্দ্র বেড়েছে এবং ভোটকক্ষ বেড়েছে ২৬.২২ শতাংশ; যা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন ইসির সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা।
যদিও নীতিমালায় গড়ে তিন হাজার ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র নির্ধারণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া সর্বশেষ অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের এখতিয়ার ও ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়।
বর্তমান কমিশনের অধীনে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘ভিজিল্যান্স ও অবজারভেশন টিম’ এবং ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেল’র প্রধান ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। রংপুর সিটি নির্বাচন উপলক্ষ্যে জারি করা পরিপত্র-৪ এ ওই দায়িত্ব থাকার কথা উল্লেখ ছিল।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেল’র প্রধানের দায়িত্ব ইসির কর্মকর্তার বদলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে পরিপত্র জারি করে ইসি।
ওই পরিপত্রে ভিজিল্যান্স ও অবজারভেশন টিমের কার্যক্রমও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সমন্বয় করে করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এভাবে একের পর এক ক্ষমতা কমানোর ঘটনায় ইসির কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে ডিসি, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে ইউএনও এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনিতেই নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন।
এখন তফসিল ঘোষণার আগেও প্রস্তুতিমূলক কাজে তাদের সম্পৃক্তা বাড়ানো হচ্ছে।
তারা বলেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশীজনরা ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন।
এমনকি আগামী নির্বাচনে নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ নির্বাচন কমিশন ওই সুপারিশের বিপরীতে গিয়ে নিজস্ব কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার কমিয়ে দিচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, নানাভাবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। কেউ কোনো বিষয়ে ভিন্নমত দিলে তাকে বদলিসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ইসির কর্মকর্তাদের এখতিয়ার কমানো নয় বরং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম।
শুক্রবার তিনি বলেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল তৈরির নীতিমালা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এটি কমিশনে তোলা হবে।
ওই সভায় কী পাশ হবে, তা আগভাগেই বলা যাচ্ছে না। এ নীতিমালার মাধ্যমে ইসি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানো হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কী কখনো কেউ একা করতে পারে।
সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে হয়। এখানে কারও ক্ষমতা কেউ নিচ্ছে না। সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আছে।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকিসংক্রান্ত কমিটির বৈঠক নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকে ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত ও নিয়োগ নীতিমালা’র খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যোগ্যতার বিষয়ে বিদ্যমান নীতিমালার সঙ্গে মিল রাখা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। এতে নবম বা তদূর্ধ্ব গ্রেডের কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং, ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তাকে সহকারী প্রিজাইডিং এবং ১১ থেকে ১৬তম গ্রেডের কর্মচারীদের পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।
তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসব পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কোনোক্রমেই জাতীয় বেতন স্কেলের ১৭-২০ গ্রেডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার দায়িত্ব না দেওয়ার জন্য বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ করার কথাও বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রিজাইডিং কর্মকর্তারাই মূলত ভোটকেন্দ্রের প্রধান অভিভাবক থাকেন। ভোটের পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে তারা চাইলে নির্বাচন স্থগিত করারও ক্ষমতা রাখেন।
সম্প্রতি সারা দেশে ভোটকেন্দ্রের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়াই চূড়ান্ত হিসাবে ধরা হলে আগামী নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৮০ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮ জন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৬ জন পোলিং অফিসার প্রয়োজন হবে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাছাইয়ে যে ভূমিকা থাকবে প্রশাসনের : নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এবং বিদ্যমান ও নতুন নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিগত কয়েক নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল এককভাবে তৈরি করে আসছেন নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা ওই প্যানেল থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে আসছেন। নতুন নীতিমালায় ওই পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এতে ভোটকেন্দ্র নীতিমালায় উল্লেখ করা কমিটিকেই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ওই হিসাবে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল তৈরিতে জেলা পর্যায়ের কমিটির আহ্বায়ক থাকবেন ডিসি।
তার নেতৃত্বাধীন কমিটিতে থাকবেন বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি, পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, জেলা শিক্ষা অফিসার ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার।
ওই কমিটিতে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। অপর দিকে উপজেলা পর্যায়ের কমিটির আহবায়ক হবেন ইউএনও।
তার নেতৃত্বাধীন কমিটি সদস্যরা হলেন-উপজেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও অফিসার ইন-চার্জ (ওসি)। এ কমিটির সদস্য সচিব হবেন উপজেলা বা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে খসড়া নীতিমালার ৩.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট ছকে সম্ভাব্য ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করে কমিটির কাছে উপস্থাপন করবেন। কমিটি ওই তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য তালিকা চূড়ান্ত করবে এবং নিজস্ব তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষণ করবে।
কমিটি নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার বাইরে আরও ৫০ ভাগ বেশি সংখ্যক যোগ্য ব্যক্তিকেও প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তার অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ব্যক্তিকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের অনেকেই ছুটি, অসুস্থ বা অবসরে যান। আবার অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠে।
কেউ কেউ দায়িত্ব পালনেও অপরাগতা প্রকাশ করেন। এসব বিবেচনায় বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে প্যানেলে রাখার জন্য বলা হয়েছে।
সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য দিতে হবে ইসিকে : নতুন খসড়া নীতিমালায় নির্বাচনি এলাকার সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর ও সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য নির্বাচন কমিশনকে সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
ওইসব প্রতিষ্ঠান সঠিক তথ্য দিয়েছে কি না-তা যাচাইয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য না দিলে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সহযোগিতা না করার দায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
সূত্র জাতীয় দৈনিক