টুডে ডেস্ক:-
অপেক্ষাকৃত ভালো বেতন ও সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরেও সরকারি চাকরিজীবীদের একটা ‘বড় অংশ’ আচরণবিধি ভঙ্গ করে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ সংক্রান্ত একটা চিঠিতে দুদক জানিয়েছে, এসব সরকারি চাকরিজীবীরা হয় ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, নয়তো নিজের নামে অথবা পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন।
এভাবে ‘বিপুল’ সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা। গত ২৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে দুদক জানায়, চাকরিজীবীরা আয়কর রিটার্নে তাদের সম্পদ ও তার উৎস সম্পর্কিত তথ্য উল্লেখ করলেও সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেননি। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী এই অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেওয়া ওই চিঠির একটা অনুলিপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘কমিশন মনে করে, এমন বেআইনি চর্চা দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত।’ আচরণ বিধিমালার ১৭ (১) নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অন্য বিধান অনুসারে, কোনও সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনও ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না।
অথবা দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনও কাজ কিংবা চাকরি নিতে পারবেন না।’ আবার বিধিমালার ১৭ (৩) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় নিজের পরিবারের কোনও সদস্যকে কোনও ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে যুক্ত করার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন না।’ দুদক বলছে, জনসাধারণের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ তদন্তের ভিত্তিতে তারা এ ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক সরকারি চাকরিজীবীর যুক্ততা আবিষ্কার করেছে।
আয়ের জানা উৎসের বাইরে যারা এর মাধ্যমে সম্পদ গড়ে চলেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, দুদক চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এ সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে সরকারি চাকরিজীবীদের কেবল সচেতন করার কথা বলেছে। কিন্তু, তদন্তের মাধ্যমে বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেনি। দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবদের তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের আওতায় থাকা সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালা সম্পর্কে সচেতন করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নির্দেশনা দিয়েছে। তারা জানায়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ গত ১ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ এই বিভাগের আওতাধীন সবগুলো সংস্থাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলার নির্দেশ দেয়। তবে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মনে করে, কেবল সচেতনতা তৈরিই যথেষ্ট নয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত।
দুদক যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বিষয়টি অবহিত করেছে, সেটাকে একটা ‘প্রশংসনীয়’ উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কিন্তু, কেবল সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য অনুরোধ করাটাই যথেষ্ট নয়। যারা আইন ভাঙছেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’ ইফতেখারুজ্জামানের অভিমত, আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কেবল বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলেই হবে না। এ বিষয়ে দুদককেও উদ্যোগী হতে হবে।
কারণ, বিধিবহির্ভূতভাবে আয় ও সম্পদ অর্জনের জন্য যে কারোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাটাই দুদকের কাজ। ইফতেখারুজ্জামানের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। গতকাল তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এগুলো ছিল শাস্তিযোগ্য কর্মকান্ড। একজন বিধি ভঙ্গকারী এর জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে পারতেন। এমনকি তার চাকরিও চলে যেতে পারত।’ এই ধরনের চর্চা চাকরিক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করে আলী ইমাম মজুমদার আরও বলেন, ‘আইনটির বিষয়ে কেবল সচেতনতা তৈরিই যথেষ্ট নয়। এ জন্য শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত।’
যদিও সাবেক এই আমলার ভাষ্য, চাকরির পাশাপাশি জীবিকার জন্য সহায়ক হিসেবে কিছু নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ছোট ছোট ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে জড়িত হতে দেখা যায়। এটাও আইনের লঙ্ঘন। যা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তবে, বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ সেটা বিবেচনা করতে পারে। ‘কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা যদি বড় ধরনের ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিতৃ’, বলেন আলী ইমাম মজুমদার।
চলতি মাসের শুরুতে অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার জন্য মোট বাজেটের সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক সাত শতাংশ বরাদ্দ রেখেছেন। ২০১৫ সালের পুনর্গঠিত বেতন কাঠামো অনুসারে, সরকারি চাকরিজীবীরা নিয়মিত বেতনের বাইরে আবাসন ও যাতায়াত সুবিধা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি বড় অঙ্কের অবসর ভাতাও পান তারা।
এ ছাড়া, বাড়ি নির্মাণ ও গাড়ি কেনার জন্য নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ভর্তুকিও পান তারা। দুদকের চিঠিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অনেক টাকা বানানোর কথা বলা বলেও এর পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি কত সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চিঠিতে স্বাক্ষরকারী দুদকের সচিব আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে দ্য ডেইলি স্টার। তবে, তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ডেইলি স্টারের ফোন ধরেননি।
সূত্র– দ্য ডেইলি স্টার