বিশেষ সংবাদদাতাঃ
যৌবনের উন্মাতাল উন্মাদনায় একটি স্বপ্নের পেছনে তাড়া করা শুরু। অমানুষিক পরিশ্রম, মেধা, পরিচর্যায় সেই স্বপ্নের শিশু গাছটি আজ বড় হয়েছে, শাখা- প্রশাখা গজিয়েছে, পত্র পল্লবে সুশভিত হয়ে আজ সেটি পরিপূর্ণ বৃক্ষ। কিন্তু স্বপ্নের পেছনে তাড়া করা সেই তাগড়া জোয়ানগুলো হয়ে গেছে বুড়ো। শরীরে আগের মত শক্তি নেই, কিন্তু প্রাণশক্তি এতটুকু কমেনি, মেধা, কর্মদক্ষতায় শান লেগেছে আরো। ভালোবাসার সেই স্বপ্নটিকে নিয়ে তাদের কত শখ, আল্লাদ, কত কর্মপরিকল্পনা।
স্বপ্নযাত্রা যে তাদের পরিপূর্ণ হয়নি আজও, যেতে হবে বহুদূর। এমন সময় তাদের জানিয়ে দেয়া হলো তারা এ বৃক্ষের কেউ নন, তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বিনা নোটিশে শুধুমাত্র মৌখিক নির্দেশে তাদের বের করে দেয়া হলো। গল্পটি সিলেটের নামকরা কয়েকজন তথ্য মজুরের। করোনা সংকটের অজুহাতে তাদের ২৬ বছরের চাকরি নিমিষেই নাই হয়ে গেছে।
খালি হাতে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের প্রিয় কর্মস্থল থেকে। ১৯৯৩ সালের ১ আগস্ট দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই এর সাথে সম্পৃক্ত হন আশির দশকের শক্তিমান কবি, সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন সালেহ। গত ২৬ টি বছর তিলে তিলে এ পত্রিকাকে যারা গড়ে তুলেছেন সালেহ তাদের অন্যতম। তার প্রাজ্ঞ লেখনির ঝলসানিতে নতুন মাত্রা খুঁজে পেতেন জালালাবাদের পাঠকরা।
আজ করোনাকালে আর্থিক সংকটের অজুহাতে তাকে চাকুরি থেকে বের করে দিয়েছে জালালাবাদ কর্তৃপক্ষ। খবরটি শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পেশাদার এ সাংবাদিকের। তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন। প্রস্তাব দেন বেতন লাগবে না, তারপরও যাতে তাকে তার মায়ার প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্যূত করা না হয়। নিজাম উদ্দিন সালেহ এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, তার বয়স হয়েছে, এই সময়ে কাজ না করলে বাসায় বসে বসে তিনি অসুস্থ হয়ে যাবেন, এমনকি মানষিক অবসাদে মারাও যেতে পারেন।
এই মানবিক দিকটি তুলে ধরে তিনি পত্রিকার সিইও নুরুল ইসলাম বাবুলকে অনুরোধ করেন তাকে বিনা বেতনে কাজের সুযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু তাতেও নূন্যতম মানবিকতায় সাড়া দেয়নি বাবুল। তারপরও তিনি অফিসে যান, স্ব প্রণোদিত হয়ে কাজ করেন, রিপোর্ট লেখেন, সম্পাদকীয় লিখে জমা দেন। সম্পাদক মুকতাবিস উন নূর তা ছাপেন না। নিজাম উদ্দিন সালেহ হতাশ হয়ে ছুটে যান মালিকদের দোয়ারে দোয়ারে। তাদের সহানুভূতি চান। কিন্তু কেউ পাত্তা দেননি।
জালালাবাদ সিন্ডিকেট এর দুজন প্রভাবশালী কর্ণধার জামায়াত নেতা মাওলানা হাবিবুর রহমান ও অধ্যক্ষ এম এ হান্নান তার কথা শুনেন, কিন্তু কোন ফায়সালা দেননি। মহানগর জামায়াতের আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়েরও বিস্তারিত শুনে তাৎক্ষণিক কোন সদুত্তর দেননি।
এদিকে, জালালাবাদ সিন্ডিকেট এর পরিচালকবৃন্দের কাছে ধর্না দেয়ার খবর পেয়ে পত্রিকার সিইও নুরুল ইসলাম বাবুল নিজাম উদ্দিন সালেহকে ফোন করে শাসান, দৌঁড়ঝাপ না করতে বলেন তাকে। এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর আচরণে দুচোখ ভিজে যায় প্রবীণ এ সাংবাদিকের। একই পত্রিকার পেইস্টার পদে ২৬ বছর কাজ করা জানু মিয়াও হারিয়েছেন চাকরি। করোনাজনিত আর্থিক সংকটের অজুহাতে তাকেও বের করে দেয়া হয় ।
চাকরি হারিয়ে অমানিশা দেখছেন ৫৪ বছর বয়সী এ বিশ্বস্ত কর্মী। জানালেন, জালালাবাদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত অসুস্থতা ছাড়া কোন ছুটি নেননি তিনি। জীবনের ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই ছিলো তার প্রিয় পত্রিকাকে ঘিরে। পত্রিকার কাজে নেশার মত জড়িয়ে থাকার কারণে বিয়ে, সংসার ও করা হয়নি সময়মত। গত ৪/৫ বছর আগে সহকর্মীদের চাপে বিয়ের পিড়িতে বসেন জানু মিয়া।
একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে তার। এমন সময় চাকরি হারিয়ে স্ত্রী- সন্তানকে কিভাবে খাওয়াবেন, সেই চিন্তায় সীমাহীন অস্থিরতা ভর করেছে তার মাথায়। সহকর্মীদের কাছে ফোন করে কোন কথাই বলতে পারছেন না, শুধুই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না। সদা আমোদে জানু মিয়ার চোখে ইতোপূর্বে কোনদিন কান্না দেখেননি বলে জানালেন তার দীর্ঘদিনের এক সহকর্মী।
শুধু নিজাম উদ্দিন সালেহ কিংবা জানু মিয়া নন, দীর্ঘ দিনের অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন, কম্পিউটার অপারেটর সালমান ও রুহিন এবং বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপক নেছার আহমদেরও চাকরি গেছে একই মৌখিক আদেশে। তাদের সবাই এ দূর্যোগের সময় চাকরি হারিয়ে হাহাকার করছেন।এদিকে, এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে পত্রিকার সিইও নুরুল ইসলাম বাবুল বলেন, কাউকে অফিসিয়ালি চাকুরিচ্যুত করা হয়নি। করোনার মধ্যে সীমিত পরিসরে পত্রিকা প্রকাশনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তাই মাত্র ৪ জন তরুন রিপোর্টারকে রেখে অন্যদের আপাতত ছুটিতে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং পত্রিকার আর্থিক সক্ষমতা ফিরে এলে তাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনা হবে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে গত কয়েক মাসে নির্বাহী সম্পাদক আবদুল কাদের তাপাদারসহ প্রতিশ্রুতিশীল আরো ৪ জন রিপোর্টারকে একে একে চাকুরিচ্যুত করা হয়।