মিডডে মিল কথাটা অতি পুরনো। এর সূত্রপাত হয় সম্ভবত ১৯২৫ সালে ব্রিটিশরা ইন্ডিয়াতে মাদ্রাজ করপোরেশনের মাধ্যমে। তাদের দেখাদেখি ফ্রান্স চালু করে ১৯৩০ সালে। ১৯৬২-৬৩ সালে তামিলনাড়– রাজ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য মিডডে মিল চালু করে। সমগ্র ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১৯৯৫ সাল থেকে মিডডে মিল চালুর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচীর সহায়তায় স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য পুষ্টিকর বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব অগ্রহ ও উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মিডডে মিল কার্যক্রম চালুর বিষয়ে সকলকে আহবান করেন।
তার আহবানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিভিন্নভাবে চালু হয় মিডডে মিল। মিডডে মিল বলতে যে মিল মিডডে অর্থাৎ দুপুরে খাওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রত্যেক পরিবার দুপুরের খাবারকে খুব গুরুত্ব দেয় যদিও দেশে দেশে এর ব্যতিক্রম আছে। ফলে অভ্যাসগতভাবে দুপুর হলেই ক্ষুধা লাগে। আবার ক্ষুধা না লাগলেও এসময় খেতে হবে তাই সবাই খায়। কিন্তু ছাত্রদের ক্ষেত্রে এ খাবারটা জোটেনা।
ফলে তাদের দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এটা মানিয়ে নিতে পারলেও প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকক্ষন না খেয়ে থাকা নিঃসন্দেহে কষ্টকর। মিডডে মিল কার্যক্রমে প্রথমে সাড়া দেয় ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ ও প্রবাসীরা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারী ও এসএমসির সদস্যরা।
তারা এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে নিজেদের কর্ম এলাকা কিংবা জন্মস্থানে এক দুইটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিডডে মিল চালু করে। প্রথমে সাদা ভাত, মাছ, মাংস বা ডিম দিয়ে শুরু করলেও পরে এটি খিচুরীতে রূপ নেয়। কারণ খিচুরী একটি পুষ্টিকর খাদ্য আবার এতে খরচও কম। তাই খিচুরীকে বেছে নেয়া হয়। চ্যারিটেবল সংগঠনও একাজে আগ্রহ দেখায় এবং তাদের পরিচালিত বিদ্যালয়ে মিডডে মিল চালু করে। কিন্তু কেহই এ কার্যক্রমকে আগাগোড়া চলমান রাখতে পারেনি।
ফলে এটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত সংগঠন, উপজেলা পরিষদ, বিভিন্ন এনজ্ওি ও চ্যারিটেবল সংগঠন মিডডে মিল চালু রাখতে টিফিন বক্স কিনে দিচ্ছে। কিন্তু কিভাবে এ মিডডে মিল চালু থাকবে সে ফর্মুলা তারা বাতলে দেয়নি।
ফলে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিক্ষা বিভাগ ও এসএমসির সহায়তায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ ও মা সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সচেতন করে মিডডে মিলের বিষয়ে অভিভাবকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, আপনার সন্তানটি দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে যে সকল অসুবিধা হয় তা দূর করতে না পারলে তার শরীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে এতে করে পড়ায় মনোযোগ থাকবেনা। আপনার সন্তানের জন্য সকাল বেলার খাবার থেকে সামান্য খাবার তুলে রেখে টিফিন বক্সে করে দিলে সে দুপুরে অন্তত কিছু খেতে পারবে।
যদি সকালের খাবার বাড়তি না থাকে তবে কিছু মুড়ি, খই, বিস্কুট, দেশী ফল, একটু জাউ রান্না করে, খিচুরী রান্না করে অর্থাৎ সামর্থ্য মোতাবেক ঘরের খাবারের কিছু অংশ টিফিন বক্সে দিয়ে দেয়া। পাশাপাশি একটি ছোট বোতলে নিজ ঘরের বিশুদ্ধ পানি ব্যাগে দিয়ে তার সন্তানকে স্কুলে পাঠানো। এই কাজে সবার আগে সাড়া দিয়েছে মায়েরা।
কারণ মায়েরা নিজে না খেয়েও তার সন্তানের জন্য খাবার তুলে রেখে টিফিন বক্সে দিয়ে দেয়। এখন বাবারাও এতে উৎসাহ দেখাচ্ছে এবং মায়েদের কাজটিকে সমর্থন করে সাহায্য করছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি কোন কোন এলাকায় ধনাঢ্য ও প্রবাসীদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে সপ্তাহে কিংবা মাসে একবার ভাল খাবারের ব্যবস্থা করছে।
ফলে ঐ এলাকার জনসাধারণের মধ্যে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাদের বাড়ী থেকে খাবার নিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সাথে খাচ্ছে। দেখলে মনে হবে একটি পরিবার মধ্যাহ্ন ভোজ করছে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষার্থী মিডডে মিল হিসেবে কোন একদিন কিছু আনতে না পারলে অন্য শিক্ষার্থীরা কিংবা শিক্ষকরা তাদের খাবার থেকে শেয়ার করে খাচ্ছে।
অপূর্ব এক পরিবেশ সুন্দর ও নির্মল শিক্ষালয়। মিডডে মিল চালু হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের সুস্থ্য দেহে সুস্থ্য মন কথাটির বাস্তবায়ন হচ্ছে। শরীরে শক্তি না থাকলে মনের জোর আসেনা। তাই সময়মত খাবার পেলে শরীর মনে সজীবতা ও উৎফুল্ল ভাব ফিরে আসে। ছাত্র-ছাত্রীরা ঝিমিয়ে পড়েনা। আগাগোড়া পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে পারে। পুষ্টিহীন শিশুরাও পুষ্টির অভাব দূর করার সুযোগ পায়।
বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বেড়ে যায়। পাশের হার বাড়ে এবং ঝড়ে পড়া কমে যায়। শিক্ষার্থীরা খেলাধূলায় আগ্রহ দেখায়। পাঠগ্রহণ ও পাঠদানে উৎসাহ থাকে। শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রমে সব শিশুকে নিয়োজিত করতে পারে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সুন্দর এক সমন্বয় থাকে। প্রতিটি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তৎপর হয়।
শিখন ও শেখানো কাজটি প্রাণবন্ত হয়। কঠিন বিষয়ের পাঠে তাদের বিমূখতা বা অলসতা আসেনা। বারবার ছুটির জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে তাগাদা দেয়না। যোগ্যতা ভিত্তিক পাঠদান সম্ভব হয়। পরিশেষে সকল বিদ্যালয়ে এরূপ ব্যবস্থা কার্যকর হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ঝড়ে পড়া রোধ হবে।
মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
(লেখক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নারায়ানগঞ্জ)
জ.টুডে-৬ জুলাই ১৮/বিডিএন